প্রকাশিত: Wed, May 29, 2024 3:26 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 11:22 PM

রবীন্দ্রনাথ এই পোশাকটাকে হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্যের অংশ মনে করতেন ও পছন্দ করতেন

মাসুদুজ্জামান : রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি পড়েছেন? পড়ে দেখুন, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পোশাক ছিলো মুসলমানদের ‘আচকান চাপকান’। ধুতি ও পাঞ্জাবি এবং কোট টাইয়ের তুলনায় তিনি যে চাপকান পায়জামাকে বেশি পছন্দ করতেন এই লেখা থেকে সেটা বোঝা যায়। চাপকানকে তিনি হিন্দু মুসলমানের মিলিত পোশাক বলে মনে করতেন এবং এর মধ্যে তিনি হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐক্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে তিনি উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত সংস্কৃতি ও ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা এটি। রবীন্দ্র-বিদ্বেষীরা ভালো করে লেখাটা পড়ে মাথায় ঢুকিয়ে নিন। আপনারা আবার ভেবে বসবেন না যে রবীন্দ্রনাথ এই পোশাক পরে মুসলমানদের মন জয় করতে চেয়েছিলেন। আসলে তিনি এই পোশাকটাকে হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্যের অংশ মনে করতেন ও পছন্দ করতেন। 

‘...একথা স্বীকার করিতে হইবে যে, বাংলাদেশে যে-ভাবে ধুতি চাদর পরা হয়, তাহা আধুনিক কাজকর্ম এবং আপিস-আদালতের উপযোগী নয়। কিন্তু আচকান-চাপকানের প্রতি সে-দোষারোপ করা যায় না। সাহেবি বেশধারীরা বলেন, ওটাও তো বিদেশি সাজ। বলেন বটে, কিন্তু সে একটা জেদের তর্ক মাত্র। অর্থাৎ বিদেশি বলিয়া চাপকান তাঁহারা পরিত্যাগ করেন নি, সাহেব সাজিবার একটা কোনো বিশেষ প্রলোভন আছে বলিয়াই ত্যাগ করিয়াছেন। কারণ যদি চাপকান এবং কোট দুটোই তাঁহার নিকট সমান নূতন হইতো, যদি তাঁহাকে আপিসে প্রবেশ ও রেলগাড়িতে পদার্পণ করিবার দিন দুটোর মধ্যে একটা প্রথম বাছিয়া লইতে হইতো, তাহা হইলে এ-সকল তর্কের উত্থাপন হইতে পারিত। চাপকান তাঁহার গায়েই ছিলো, তিনি সেটা তাঁহার পিতার নিকট হইতে পাইয়াছিলেন। তাহা ত্যাগ করিয়া যেদিন কালো কুর্তির মধ্যে প্রবেশপূর্বক গলায় টাই বাঁধিলেন, সেদিন আনন্দে এবং গৌরবে এ তর্ক তোলেননি যে, পিতা ও চাপকানটা কোথা হইতে পাইয়াছিলেন।

তোলাও সহজ নহে, কারণ চাপকানের ইতিবৃত্ত ঠিক তিনিও জানেন না, আমিও জানি না। কেননা মুসলমানদের সহিত বসনভূষণ শিল্পসাহিত্যে আমাদের এমন ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান হইয়া গেছে যে, উহার মধ্যে কতোটা কার, তাহার সীমা নির্ণয় করা কঠিন। চাপকান হিন্দু মুসলমানের মিলিত বস্ত্র। উহা যে-সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমান আকারে পরিণত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দু মুসলমান উভয়েই সহায়তা করিয়াছে। এখনো পশ্চিমে ভিন্ন ভিন্ন রাজাধিকারে চাপকানের অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়; সে-বৈচিত্র্যে যে একমাত্র মুসলমানের কর্তৃত্ব তাহা নহে, তাহার মধ্যে হিন্দুরও স্বাধীনতা আছে। যেমন আমাদের ভারতবর্ষীয় সংগীত মুসলমানেরও বটে হিন্দুরও বটে, তাহাতে উভয়জাতীয় গুণীরই হাত আছে; যেমন মুসলমান রাজ্যপ্রণালীতে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিলো।

তাহা না হইয়া যায় না। কারণ মুসলমানগণ ভারতবর্ষের অধিবাসী ছিলো। তাহাদের শিল্পবিলাস ও নীতিপদ্ধতির আদর্শ ভারতবর্ষ হইতে সুদূরে থাকিয়া আপন আদিমতা রক্ষা করে নাই এবং মুসলমান যেমন বলের দ্বারা ভারতবর্ষকে আপনার করিয়া লইয়াছিলো, ভারতবর্ষও তেমনই স্বভাবের অমোঘ নিয়মে কেবল আপন বিপুলতা আপন নিগূঢ় প্রাণশক্তির দ্বারা মুসলমানকে আপনার করিয়া লইয়াছিলো। চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্রব্য-নির্মাণ, দন্তকার্য, নৃত্য, গীত এবং রাজকার্য, মুসলমানের আমলে ইহার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে। তখন ভারতবর্ষের যে একটি বাহ্যাবরণ নির্মিত হইতেছিলো, তাহাতে হিন্দু ও মুসলমান ভারতবর্ষের ডান হাত ও বাম হাত হইয়া টানা ও পোড়েন বুনিতেছিলো। অতএব এই মিশ্রণের মধ্যে চাপকানের খাঁটি মুসলমানত্ব যিনি গায়ের জোরে প্রমাণ করিতে চান, তাঁহাকে এই কথা বলিতে হয় যে, তোমার যখন গায়ের এতোই জোর, তখন কিছুমাত্র প্রমাণ না করিয়া ঐ গায়ের জোরেই হ্যাটকোট অবলম্বন করো, আমরা মনের আক্ষেপ নীরবে মনের মধ্যে পরিপাক করি। এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনোমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনোদিন সহস্র অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানে ধর্মে না-ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা আমাদের মহৎ স্বার্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে। অতএব যে-বেশ আমাদের জাতীয় বেশ হইবে তাহা হিন্দু মুসলমানের বেশ।  যদি সত্য হয়, চাপকান পায়জামা একমাত্র মুসলমানদেরই উদ্ভাবিত সজ্জা, তথাপি এ কথা যখন স্মরণ করি, রাজপুতবীরগণ শিখসর্দারবর্গ এই বেশ পরিধান করিয়াছেন, রাণাপ্রতাপ রণজিৎসিংহ এই চাপকান পায়জামা ব্যবহার করিয়া ইহাকে ধন্য করিয়া গিয়াছেন, তখন মিস্টার ঘোষ-বোস-মিত্র, চাটুয্যে-বাড়ুয্যে-মুখুয্যের এ বেশ পরিতে লজ্জার কারণ কিছুই দেখি না। কিন্তু সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক কথা এই যে, চাপকান পায়জামা দেখিতে অতি কুশ্রী। তর্ক যখন এইখানে আসিয়া ঠেকে তখন মানে মানে চুপ করিয়া যাওয়া শ্রেয়। কারণ রুচির তর্কের, শেষকালে প্রায় বাহুবলে আসিয়াই মীমাংসা হয়।’ (আংশিক)।  প্রবন্ধের নাম: ‘কোট বা চাপকান’। গ্রন্থ : সমাজ। রবীন্দ্রসমগ্র, ষষ্ঠ খণ্ড। ফেসবুক থেকে